“আবহাওয়া বেশ কিছুদিন ধরে ছিল গুমোট আর উষ্ণ। এপ্রিলের দুই তারিখ বিকাল পাঁচটায় প্রথম মৃদু একটা কম্পন, তারপর বাড়তে বাড়তে এমন ভয়ানক ঝাঁকুনি শুরু হলো। পরবর্তী দুই মিনিট চারপাশের পাহাড়, বাড়িঘর, গাছপালা সব থরথর করে কাঁপতে লাগল। এত জোরে কাঁপছিল যে পায়ের তাল রাখা যাচ্ছিল না। স্থানীয় কয়েকজন কৃষ্ণাকায় লোক ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল। এদের কয়েকজন প্রবল আতঙ্কে ওখানেই মারা গেল… কপাল ভালো আমরা কাঠের বাংলোতে ছিলাম। যদি ইটের বাড়িতে থাকতাম, তাহলে এতক্ষণে মাটিতে মিশে যেতাম। দুর্গের মধ্যে যে ঘরটি ইটসুরকি দিয়ে সবচেয়ে মজবুত করে বানানো হয়েছে সেটি ভেঙে গেছে। পুরোনোটি ভেঙে চুরমার হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।”
এই বিবরণটি এখনকার নয়, আড়াইশ বছরেরও বেশি আগের। ১৭৬২ সালের ২ এপ্রিল, বিকেল ঠিক পাঁচটা। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার আর তখনকার আরাকান—সবাইকে একসঙ্গে গ্রাস করেছিল উপমহাদেশের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প। মাত্রা ছিল আনুমানিক ৮.৫ থেকে ৮.৮। এই শক্তির ভূমিকম্প আজ হলে পুরো অঞ্চলের মানচিত্রই বদলে যেত।

চট্টগ্রামের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর হ্যারি ভেরেলস্ট কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর জেনারেল হেনরি ভ্যানসিটার্টকে শরীর শীতল করে দেওয়া সেই অভিজ্ঞতা লিখে জানান তিনি। সেটাই পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে লেখার শুরুতে। পুরো শহর আর পাহাড়ের ওপর নেমে এলো এক অচিন্তনীয় বিভীষিকা।
ভূমিকম্পের কম্পনের সঙ্গে কামানের গর্জনের মতো ১৫ বার বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এটা নথিবদ্ধ করেছেন এডওয়ার্ড গালস্টোন নামে আরেক প্রত্যক্ষদর্শী। মাটির ভেতর থেকে কোথাও কোথাও ধোঁয়া উঠছিল; কোথাও টক সালফারের গন্ধমাখা পানি ফেটে উঠে আসছিল। যেন অদৃশ্য এক দানব মাটির নিচে শরীর ছুঁড়ে ছুঁড়ে লাফাচ্ছে।

সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে সেই দানবের ছোঁয়া আরও ভয়াবহ ছিল। পাহাড়ের ঢালে লম্বা ফাটল তৈরি হয়ে সেটা থেকে “আগুনের মতো তাপ” বেরোতে দেখে স্থানীয়রা ভয়ে পালিয়ে যায়। পরে গবেষণায় দেখা গেছে—ভূগর্ভে আটকে থাকা গরম গ্যাস, সালফার ও কাদা একসঙ্গে ছিটকে বের হয়েছিল। আশপাশের লোকেরা যে এটাকে আগ্নেয়গিরির মতো উদগিরণ ভেবেছিল, তা মোটেও বাড়াবাড়ি ছিল না।
চট্টগ্রাম শহরের ভেতরে সেই মুহূর্তে কী হচ্ছিল, তা যে কেউ কল্পনা করলে শিউরে উঠবে। শহরের মাটির বাড়ি, ইটের বাড়ি কোনোটাই দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুর্গ, যে ভবনটি সবচেয়ে মজবুত বলে মনে করা হতো, সেটিও টিকে থাকেনি। ভেরেলস্ট লিখেছিলেন, “ইটসুরকি দিয়ে বানানো ঘরটি ভেঙে গেছে, পুরোনো দুর্গ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।”

কিন্তু এই ভয়াবহ ধসের মধ্যেই ঘটে যায় আরও অবিশ্বাস্য সব ঘটনা। চট্টগ্রাম শহরের নানা জায়গায় হঠাৎ করে বিশাল ফাটল ধরে যায়, ভূগর্ভ থেকে উঠে আসে হলুদাভ, সালফারের গন্ধযুক্ত পানি।
আবার চট্টগ্রামের বহু জায়গার পুকুর আর পরিখা—যেখানে সবসময় পানি থাকে, সেগুলো মিনিটের মধ্যেই শুকিয়ে যায়। যেন অদৃশ্য কেউ বিশাল বালতি দিয়ে পানি তুলে নিয়েছে। দেয়াং পরগনার (এখনকার চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলী) বহু জায়গায় মাটি তিন থেকে পাঁচ ফুট জায়গা দম করে নিচে বসে যায়, কোথাও আবার ভূমি এক-দেড় হাত ওপরে উঠে আসে। ভূমিকম্পের পরপরই কর্ণফুলী নদীর পানি শহরের দিকে ধেয়ে আসে; নদীর উল্টো-পাশের গ্রাম ডুবে যায় সাত ফুট পানির নিচে।

সবচেয়ে রহস্যময় ঘটনা ঘটে কক্সবাজারের কাছেই, বাহারছড়া এলাকায় (বর্তমানে টেকনাফ উপজেলায় পড়েছে)। কয়েক শ মানুষসহ পুরো একটি গ্রাম একেবারে মাটির নিচে তলিয়ে যায়, এবং তা সাগরের অংশ হয়ে যায়। কোনো চিহ্ন, কোনো দেহ, কোনো খোঁজ আর পাওয়া যায় না। ভূতাত্ত্বিকরা মনে করেন, এই নিমজ্জন ছিল পৃথিবীর প্লেট হঠাৎ করে নিচে বসে যাওয়ার ফল। একই রকম ধস দেখা যায় বরকল অঞ্চলে। সেখানে চল্লিশ ফুট লম্বা এক ফাটল পাহাড়ের বুক চিরে চলে যায়। কাসালং এলাকায় পুরো পাহাড়ের একটি অংশ পানির নিচে তলিয়ে যায়।
ভূমিকম্পের পরের ২৪ ঘণ্টায় আরও ১১টি কম্পন নথিবদ্ধ হয়, অন্য কথায় ভয়াল সব আফটারশক। প্রতিটি নতুন ঝাঁকুনি মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে পৃথিবী এখনো স্থির হয়নি। রাতভর মানুষ খোলা আকাশের নিচে, নদীর ধারে বা উঁচু পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে কাটিয়েছে।

কিন্তু শুধু চট্টগ্রাম নয়, পূর্বদিকে আরাকান (বর্তমান রাখাইন রাজ্য) ছিল এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রের সবচেয়ে কাছে। সেখানে সমুদ্রভূমি প্রায় ২–৩ মিটার পর্যন্ত উঠে আসার প্রমাণ আজও পাওয়া যায়। আর বঙ্গোপসাগর জুড়ে সৃষ্টি হয় বড় সুনামির ঢেউ। বাংলাদেশ উপকূলে পানি উঠে আসে ৮–১০ ফুট পর্যন্ত। স্থানীয় লোকেরা “জলডমকা” শব্দে যে হঠাৎ সাগরের আওয়াজ শুনেছিল, তা বিজ্ঞানীরা এখন সুনামির প্রথম তরঙ্গ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
ভূমিকম্প এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ পর্যন্ত বদলে যায়। গবেষকরা এটাকে বলেন tectonic avulsion—পৃথিবীর ভেতরের শক্তি নদীর পথকে নতুন দিকে ঠেলে দেয়। ১৭৬২ সালের পরে পুরনো ব্রহ্মপুত্র ক্রমে শুকিয়ে গিয়ে নতুন প্রবাহে যমুনা হয়ে ওঠে, আজকের বাংলাদেশের ভূগোলকে যে নদী নির্ধারণ করে।

চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক চেহারায় যে পরিবর্তন আজ দেখা যায়—মাটি বসে যাওয়া, কোথাও কোথাও হঠাৎ উঁচু টিলা, উপকূলের ভাঙন, তার অনেকটাই ১৭৬২ সালের সেই দিনের ফল। বর্তমান গবেষণা বলে—Bay of Bengal Subduction Zone-এ সেই ভূমিকম্প যে শক্তি মুক্ত করেছিল, তা এতটাই বড় ছিল যে এই অঞ্চলে ভূকম্পন চক্রের পুনরাবৃত্তি-সময় প্রায় ৪০০–৫০০ বছর হতে পারে। অর্থাৎ সেই দিনের মতো আরেকটি দিন ভবিষ্যতেও ফিরে আসতে পারে।
আরেকটি কম পরিচিত কিন্তু বড় ঐতিহাসিক মোড়ও তৈরি হয় এই ভূমিকম্পে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন চট্টগ্রামকে প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু ভূমিকম্পে শহরের ভয়াবহ ক্ষতি ও উপকূলের অস্থিতিশীলতায় সেই পরিকল্পনা বাতিল হয়। কোম্পানি ১৭৭২ সালে কলকাতাকে নতুন কেন্দ্র বানায়—যা পরবর্তীতে পুরো উপমহাদেশের ইতিহাস বদলে দেয়।
১৭৬২ সালের সেই দিনের দিকে ফিরে তাকালে মনে হয়, একটি দিনই কেমন করে হাজার বছরের ভূগোল, ইতিহাস, মানুষের জীবন ও সাম্রাজ্যের সিদ্ধান্তকে বদলে দিতে পারে। পাহাড় ফেটে আগুন বেরোনোর গন্ধ, নোনা সাগর গিলে নেওয়া গ্রাম, মাটির নিচে ডুবে যাওয়া বসতি—এইসব গল্প শুধু অতীত নয়। এগুলো পৃথিবীর সেই ভয়াল শক্তির স্মারক, যে শক্তি নিঃশব্দে হাজার বছরের অপেক্ষায় থাকে।
সূত্র :
উপনিবেশ চট্টগ্রাম : ৫০০ বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস। লেখক: হারুন রশীদ, Microatolls document the 1762 earthquake, রাটগারস ইউনিভার্সিটি
Analysis of AD 1762 earthquake and tsunami, রিসার্চগেট NOAA — Significant Earthquake Database: Chittagong 1762 (এন-ও-এ-এ)।